যুদ্ধ নৃশংস অর্থনৈতিক খেলা ও লাভবানদের তালিকা।
বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধ শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক স্বার্থের অন্যতম চালিকাশক্তি। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইউক্রেনের মতো দেশগুলোতে যুদ্ধ বাধিয়ে সেখানে সরকার পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের নামে শত শত বিলিয়ন ডলার ঢালা হয়েছে। এই অর্থ মূলত পশ্চিমা সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের পকেটে প্রবাহিত হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ: সামরিক ব্যয় ও অর্থনৈতিক প্রবাহ
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকেই ইউক্রেন পশ্চিমা সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সামরিক ব্যয়ের বড় অংশই পশ্চিমা অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর পকেটে প্রবাহিত হয়েছে।
১. যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা:
- ২০২২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে প্রায় ৬৯.২ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে।
- এই অর্থ মূলত লকহিড মার্টিন, রেথিয়ন টেকনোলজিস, নর্থ্রপ গ্রামম্যানের মতো কোম্পানিগুলোর অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হয়েছে।
২. ইউরোপীয় সাহায্য:
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৪ থেকে ইউক্রেনকে প্রায় ১৩২ বিলিয়ন ইউরো সামরিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা দিয়েছে।
- এই অর্থের একটি বড় অংশ ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলো যেমন এয়ারবাস ও থ্যালেস গ্রুপের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েছে।
৩. বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ঋণ:
- ২০১৪ সালে আইএমএফ ১৭ বিলিয়ন ডলারের একটি উদ্ধার প্যাকেজ ঘোষণা করে, যার শর্ত ছিল কঠোর অর্থনৈতিক সংস্কার।
- ২০২০ সালে ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি ১৮ মাসের স্ট্যান্ডবাই ব্যবস্থা অনুমোদন করা হয়।
- ১৯৯৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ইউক্রেন আইএমএফ থেকে মোট ৩৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে।
- বিশ্বব্যাংক ২০০৪-২০২১ সময়কালে মাইন পরিষ্কার ও অবকাঠামো উন্নয়নে ৭৭.৩ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে।
কোন কোম্পানি ও ব্যক্তি লাভবান হয়েছে?
- প্রতিরক্ষা খাতে: লকহিড মার্টিন, রেথিয়ন, নর্থ্রপ গ্রামম্যান, বিএই সিস্টেমস, এয়ারবাস, থ্যালেস গ্রুপ।
- জ্বালানি খাতে: ইউক্রেনের শক্তি কোম্পানি বুরিসমা, যেখানে হান্টার বাইডেন ২০১৪ সালে বোর্ড সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়ে প্রতি মাসে ৫০,০০০ ডলার আয় করতেন।
- রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব: ইউক্রেন ও পশ্চিমা রাজনীতিবিদেরা এই বিশাল আর্থিক লেনদেনের সুবিধাভোগী। মার্কিন সিনেটে প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই অর্থ প্রবাহ থেকে লাভবান হয়েছে।
যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন: নতুন অর্থনৈতিক উপনিবেশ
যুদ্ধ শেষে ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য আসবে ব্ল্যাক রক-এর মতো বিনিয়োগ কোম্পানিগুলো। তাদের লক্ষ্য থাকবে কমপক্ষে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই ধরনের পুনর্গঠন প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থ শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর জনগণের উন্নয়নের পরিবর্তে তাদের সম্পদ হরণের মাধ্যমে নতুন ধরণের অর্থনৈতিক উপনিবেশ গড়ে তোলে।
ইউক্রেনের বর্তমান যুদ্ধ পশ্চিমা সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স, কর্পোরেট অর্থনীতি ও রাজনৈতিক লবিং-এর একটি বিশাল মুনাফার খেলা। এটি দেখিয়ে দেয় কিভাবে রাষ্ট্রশক্তি, মিডিয়া ও কর্পোরেট স্বার্থ একত্রিত হয়ে একটি যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত ও লাভজনক করতে পারে। এটি কেবল ইউক্রেন নয়, বরং যেকোনো দরিদ্র ও রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশকে সামরিক ও অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করার একটি পরিচিত পদ্ধতি।