দস্তগীর জাহাঙ্গীর বিশ্লেষণ ! ওয়াকারের আঞ্চলিক রাজনীতির নতুন সমীকরণ |



দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা ইস্যু এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কৌশলগত হিসাব-নিকাশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। তার কথাবার্তা এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা এখন শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলছে।

ড. ইউনুস ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ড. ইউনুস নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন এমন এক সময়, যখন দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম উত্তপ্ত। প্রথমদিকে মনে করা হয়েছিল, তিনি এক নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা করবেন, যা বাংলাদেশকে এক নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে পরিচালিত করবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে।

তার সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ড শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে না, বরং তা ভারতের ভূখণ্ডগত নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কিছু বক্তব্য ভারতের শাসকগোষ্ঠী এবং কূটনীতিকদের মধ্যে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মনে করছেন, বাংলাদেশে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সরাসরি ভারতের নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের দৃষ্টিতে, ড. ইউনুসের রাজনৈতিক অবস্থান শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে না, বরং ভারতের সীমান্ত ও আঞ্চলিক স্বার্থের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের নীরব কূটনীতি ও ভারতের কঠোর বার্তা

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন এই ইস্যুতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে না। বরং তারা বাংলাদেশ ইস্যুটি পুরোপুরি ভারতের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভারত তার ভূখণ্ডগত নিরাপত্তার প্রশ্নে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে এবং প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

ভারতের জন্য এটি একটি কৌশলগত বার্তা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট বা অস্থিতিশীলতা যদি ভারতের সীমান্ত বা স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, তবে ভারত কোনো ধরনের দ্বিধা ছাড়াই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূরাজনৈতিক অবস্থান অনেক শক্তিশালী, এবং তারা অতীতে বহুবার দেখিয়েছে যে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তারা কঠোর হতে পারে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বিতর্কিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে। গত সাত মাসে ৩২ নম্বর ভাঙা সহ নানা কর্মকাণ্ড তাদের ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন তুলেছে। সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড এবং তার প্রতি সরকারের নির্ভরতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই সন্দিহান।

বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে—যে বাহিনী নিজ দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, তারা কীভাবে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় অবদান রাখতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বিভিন্ন সময়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করা হতে পারে। এটি সেনাবাহিনীর জন্য একটি বড় সংকেত, কারণ শান্তিরক্ষা মিশন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান বৈদেশিক আয়ের উৎস।

ওয়াকারের হুঙ্কার ও ভবিষ্যতের সংকেত

এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সাম্প্রতিক বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তার হুঙ্কার ইঙ্গিত দেয় যে, সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

একদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে সেনাবাহিনী এখন নাজুক অবস্থানে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য তারা লড়াই করছে। সেনাবাহিনীর অবস্থান যে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে, তা স্পষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায়, ভারতের ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা ও দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার প্রশ্নে ভারত যে কঠোর অবস্থান নেবে, তা নিশ্চিত। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ—রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা, আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এই বাস্তবতায়, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে:

ড. ইউনুসের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে?

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা কতটা টিকে থাকবে?
ভারতের ভূখণ্ডগত নিরাপত্তা রক্ষায় তারা কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?

এই তিনটি ইস্যুই আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত পরিস্থিতিকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করতে পারে। সময়ই বলে দেবে, বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য কতটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url