বাংলাদেশকে ‘নিরাপদ রাষ্ট্র’ ঘোষণার পরিণতি: ইউরোপে আশ্রয়ের পথ বন্ধের দ্বারপ্রান্তে!
বাংলাদেশকে ‘নিরাপদ রাষ্ট্র’ ঘোষণার পরিণতি: ইউরোপে আশ্রয়ের পথ ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে
নিজস্ব প্রতিবেদক -
সম্প্রতি ইউরোপীয় কমিশন বাংলাদেশকে পুনরায় ‘নিরাপদ রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অবস্থানরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের উপর, বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক আশ্রয় ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন অথবা করতে চলেছেন।
নিরাপদ রাষ্ট্র কী এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?
‘নিরাপদ রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃত দেশগুলোর নাগরিকরা ইউরোপে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করলে সেটি সাধারণত গৃহীত হয় না, কারণ ধারণা করা হয়, এসব দেশে রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধ বা মৌলিক চিকিৎসা সুবিধার অভাব নেই। ফলে, এই দেশগুলোর নাগরিকরা ‘নির্যাতনের শিকার’ বা ‘ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি’ হিসেবে বিবেচিত হন না।
২০১১ সালের পুনরাবৃত্তি ও বর্তমান সংকট
এটি নতুন কিছু নয়। ২০১১ সালেও বাংলাদেশকে নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার পর ইউরোপজুড়ে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনের হার ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। বহু মানুষকে তখন দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল, কেউবা আত্মগোপনে, কেউবা অনিয়মিত অভিবাসী হয়ে জীবন চালিয়েছেন সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে।
বর্তমানে সেই একই ধারা ফেরত আসছে, তবে এবার পরিস্থিতি আরও কঠিন। ইউরোপীয় কমিশনের সর্বশেষ ঘোষণায় বাংলাদেশের উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে—বাংলাদেশিদের আর ইউরোপে রাজনৈতিক বা মানবিক আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই।
অভিযোগ: রাজনৈতিক স্বার্থে ‘নিরাপত্তা’র প্রচার?
এই প্রেক্ষাপট ঘিরে একটি বড় প্রশ্ন উঠে এসেছে—বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপনের নেপথ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল কি না?বিশ্বস্ত সূত্র মতে, বর্তমান ইউনুস সরকার বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশলের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে, বাংলাদেশকে একটি “আধুনিক, সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ রাষ্ট্র” হিসেবে তুলে ধরতে লবিং ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এসেছে। এই প্রচেষ্টার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় সমর্থন নিশ্চিত করা এবং দেশীয় বিরোধীদের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ করা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের সক্রিয় লবিং এবং আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে কৌশলগত বোঝাপড়ার ফলেই এই ‘নিরাপদ রাষ্ট্র’ ঘোষণাটি এসেছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে প্রবাসে থাকা হাজারো বাংলাদেশির জীবনে।
ফ্রান্সসহ ইউরোপজুড়ে আবেদন প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কা।
এই ঘোষণার পর ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রশাসনিক সংস্থাগুলো এখন বাংলাদেশি আবেদনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক বা স্বাস্থ্যগত যুক্তিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে দেখছে। এমনকি যারা গুরুতর অসুস্থ, যাদের চিকিৎসা ফ্রান্সে চলছে, তাদেরও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে:
“এই চিকিৎসা আপনার দেশে পাওয়া যায়।”
ফলে, ‘মালাদি কার্ড’ বা চিকিৎসা-ভিত্তিক মানবিক অনুমতির আবেদনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রত্যাখ্যান লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত
ইউরোপের অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি এবং নিরাপদ রাষ্ট্রের তালিকা সম্প্রসারণের ফলে আগামী দিনে বাংলাদেশিদের আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ আরও সংকুচিত হবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। যারা ইতিমধ্যেই ইউরোপে অবস্থান করছেন, তাদের উচিত হবে বিকল্প বৈধতার পথ খোঁজা, যেমন: শ্রমভিত্তিক রেসিডেন্স পারমিট, পারিবারিক একীকরণ বা শিক্ষাগত উদ্দেশ্য। যা অত্যন্ত কঠিন অবাস্তব।
দরজা বন্ধ হওয়ার আগে সজাগ হোন
বাংলাদেশকে নিরাপদ রাষ্ট্র ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় অভিবাসন ব্যবস্থায় এক গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। একদিকে এটি সরকারপ্রধানের আন্তর্জাতিক সফলতা হিসেবে দেখা গেলেও, অন্যদিকে হাজারো বাংলাদেশি অভিবাসীর জন্য এটি ভবিষ্যতের অন্ধকার দ্বার।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সংগঠিত, সচেতন ও কৌশলভিত্তিক প্রস্তুতি—যাতে যারা প্রকৃত ঝুঁকিতে রয়েছেন, তারা রক্ষা পেতে পারেন এবং বাকিরা সামনে কী আসছে তা বুঝে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেন।