তদন্ত প্রতিবেদন কালাজ্বর নির্মূল প্রকল্পে পিনাকী ভট্টাচার্যের সম্পৃক্ততা।



বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
কালাজ্বর নির্মূল প্রকল্পে পপুলারের ওষুধ কেলেঙ্কারি: ৫ কোটি টাকা লুটপাট, ২৮৯ জনের মৃত্যুতে পিনাকী ভট্টাচার্যের সম্পৃক্ততা।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কালাজ্বর নির্মূলের লক্ষ্যে সারা দেশে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের প্রকল্প হাতে নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) অর্থায়নে পরিচালিত এই কর্মসূচির আওতায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মিল্টেফসিন (Miltefosine) ওষুধ বিতরণের কথা ছিল। তবে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গুণগত মান বিবেচনা না করেই বাংলাদেশের পপুলার ফার্মাসিটিক্যালসকে এই ওষুধ সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই চক্রান্তের মূল কারিগর ছিলেন পপুলার ফার্মাসিটিক্যালসের তৎকালীন চিফ অপারেটিং অফিসার (COO) পিনাকী ভট্টাচার্য।

টেন্ডার কারসাজি: কীভাবে পপুলার পেল ওষুধ সরবরাহের দায়িত্ব?

প্রকল্পের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মিল্টেফসিন সংগ্রহের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে। এতে অংশ নেয় জার্মানির ‘Eterna Zentaris’ এবং বাংলাদেশের ‘Popular Pharmaceuticals’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) শর্ত ছিল—
ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
ওষুধের মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হতে হবে।

কিন্তু পপুলার ফার্মাসিটিক্যালসের এই ওষুধ তৈরির কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, এবং তাদের তৈরি মিল্টেফসিনের গুণগত মান যাচাই না করেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রহস্যজনকভাবে তাদেরকেই ওষুধ সরবরাহের অনুমোদন দেয়।

এখানেই শেষ নয়, যখন WHO বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তোলে এবং অর্থায়ন স্থগিত করার হুমকি দেয়, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন করে টেন্ডার ডেকে ২ বছরের অভিজ্ঞতার শর্তটিই সরিয়ে ফেলে—শুধুমাত্র পপুলারকে বাঁচাতে!

ভেজাল ওষুধ সরবরাহ: রোগীদের সঙ্গে চরম প্রতারণা

সরকার পপুলারের কাছ থেকে ৫ কোটি টাকার ওষুধ কিনে বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করে। অথচ পরীক্ষায় দেখা যায়, পপুলারের তৈরি ওষুধে মূল উপাদান মিল্টেফসিনের কোনো অস্তিত্বই নেই!

এই ক্যাপসুলগুলোতে কার্যকরী উপাদান থাকার কথা থাকলেও এগুলো ছিল শুধুমাত্র ময়দা দিয়ে তৈরি!

ফলে শত শত রোগী পুরো ডোজ গ্রহণ করেও সুস্থ হয়নি, বরং তাদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।

সারা দেশে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৮৯ জন রোগী মারা যায়।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিনাকী ভট্টাচার্যই পপুলারের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে এই প্রতারণার জাল বিস্তার করেন।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও পিনাকী ভট্টাচার্যের সংশ্লিষ্টতা

প্রথম আলো (২০০৮, জুন ১০)

"কালাজ্বর প্রকল্পে ওষুধ কেলেঙ্কারি: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পপুলারের গোপন চুক্তি" শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—

> "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালার পরিপন্থীভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি অনভিজ্ঞ কোম্পানিকে (পপুলার ফার্মাসিটিক্যালস) কোটি কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহের অনুমতি দিয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, এই কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার পিনাকী ভট্টাচার্য ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে চুক্তি আদায় করেন।"


বিডিনিউজ২৪ (২০০৮, জুলাই ১৫)

"নকল ওষুধে ২৮৯ জনের মৃত্যু, WHO অর্থায়ন স্থগিত" শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—

> "স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পপুলারের মধ্যে হওয়া চুক্তির মূল হোতা ছিলেন পিনাকী ভট্টাচার্য। তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে প্রকল্পের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদন পায়। WHO তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে যে, বিতরণ করা ওষুধগুলোর মধ্যে কার্যকরী উপাদান ছিল না, যা এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অপরাধ।"

পিনাকী ভট্টাচার্য ও প্রতারক চক্রের অপকর্ম

এই ওষুধ কেলেঙ্কারির পেছনে ছিল একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র, যারা ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের ওষুধ চোরাইপথে আমদানি করে বিদেশি সিল লাগিয়ে বাজারজাত করত।

পিনাকী ভট্টাচার্য এই চক্রের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন।

তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করেন।

পরবর্তীতে বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে র‍্যাব পপুলারের কারখানায় অভিযান চালায় এবং বেশ কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করে।

ভেজাল ওষুধ কেলেঙ্কারির পরিণতি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত

WHO নিশ্চিত হয় যে, পপুলারের ওষুধ কার্যকর নয় এবং এটি রোগীদের মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

সংস্থাটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়ন স্থগিত করে এবং ভবিষ্যতে অনিয়ম হলে দেশটির বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়।

গণমাধ্যমের চাপে পড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পপুলারের ওষুধ ক্রয় বন্ধ করে।

র‍্যাবের অভিযানের পরও মূল হোতারা তখনো শাস্তির বাইরে থেকে যায়।



কালাজ্বর নির্মূল প্রকল্পের এই দুর্নীতি শুধু জনগণের জীবন বিপন্ন করেনি, বরং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে।
২৮৯ জনের মৃত্যু
সরকারের ৫ কোটি টাকা লুটপাট
জনগণের সঙ্গে ভয়ংকর প্রতারণা
এই অপকর্মের অন্যতম হোতা পিনাকী ভট্টাচার্য ও তার সহযোগী চক্র আজও কীভাবে আইনের বাইরে?
দেশের জনগণ এর সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—
আদৌ কি ন্যায়বিচার হবে, নাকি ক্ষমতার দাপটে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে?


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url